বিদ্যুৎ বিতরণী কোম্পানিগুলোর অসাধু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় বিদ্যুতের অবৈধ ব্যবহার বেড়েছে। এতে করে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। অভিযোগ উঠেছে, বিতরণী কোম্পানিগুলো স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে অনীহা প্রকাশ করায় পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। এই প্রবণতা বন্ধ করে টাস্কফোর্স সদস্যদের আরো তৎপর হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি, জনগণকে এই বিষয়ে সচেতন করে তুলতে মাঠপর্যায়ে আরো কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চার্জ থেকে শুরু করে রাজধানীর ফুটপাথ দখল করে গড়ে ওঠা দোকান, বস্তিঘর, আবাসিক ভবন, ছোট ছোট কারখানায় দেদারছে চলছে অবৈধ বিদ্যুৎ চুরির মহোৎসব। সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এভাবে মিটার ছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে যেমন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছেন অনেকে।
সরেজমিন মাতুয়াইল, ডেমরা, যাত্রাবাড়ি, জুরাইন, কাজলা, কদমতলী, পোস্তগোলা, মীরহাজিরবাগ, লালবাগ, চকবাজার, পোস্তা, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, রামপুরা, মাদারটেকের নন্দীপাড়া ও দক্ষিণগাঁও, রায়ের বাজার, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গুলিস্তান, পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলি ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে। আবার এসব এলাকার কিছু জায়গায় রয়েছে একাধিক ক্ষুদ্রশিল্পের কারখানা। সেখানেও বিতরণী কোম্পানিগুলোর অসাধু কর্মকর্তাদের আঁতাতে চলে মাসিক চুক্তিভিত্তিক বিদ্যুৎ ব্যবহার। এভাবেই বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
বিগত সরকার রাজধানীর ফুটপাতগুলোতে বিদ্যুৎচুরি ঠেকাতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। ওই এলাকাগুলোতো একজন ভাসমান ব্যবসায়ীর জিম্মায় একটি মিটার দিয়ে বৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছিল। এতে তৎকালীন সরকার বিদ্যুৎচুরি কিছুটা কমাতে পারলেও পুরোপুরি সফল হয়নি। পাঁচ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ ও নির্ধারিত মিটারের বাইরে দিয়ে বাইপাস করে বিদ্যুৎ ব্যবহার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়। এর কারণ হিসাবে বিদ্যুৎ বিতরণী কোম্পানিগুলোর নজরদারির অভাব ও অসাধু কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্যকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাঁরা বলছেন, বিদ্যুৎ বিতরণী কোম্পানির টাস্কফোর্সের লোকবল সংকট ও ম্যাজিস্ট্রেট কম থাকায় অনেক সময় অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। আর এ্ররই সুযোগ নিচ্ছেন বিতরণী কোম্পানিগুলোর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা সরকারকে রাজস্ববঞ্চিত করে নিজেদের আখের গুছাচ্ছেন।
সূত্র জানায়, কোনো কোনো জায়গায় প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা থাকায় বিদ্যুৎচুরি ঠেকাতে পারছে না রাজধানীর অন্যতম বিদ্যুৎ বিতরণী সংস্থা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। বিদ্যুৎচুরির ঘটনায় সংস্থার প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নাম আসলেই বিব্রত হয় কর্তৃপক্ষ। নামকাওয়াস্তে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দুর্নীতিবাজরা তখন তদন্ত কমিটিকে 'ম্যানেজ' করে ফেলেন। ফলশ্রুতিতে তদন্ত কমিটি দায়সারা প্রতিবেদন দাখিল করে। আবার মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে এই বিদ্যুৎচুরি নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের অন্য জায়গায় বদলি করে থাকে।
এমন ঘটনা ঘটছে বার বার। এতে ক্ষুব্ধ সৎ ও দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা। তাঁরা বলছেন, অসৎ লোকদের সংখ্যা খুবই অল্প। এদের দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠান কেন কলুষিত হবে? এই শ্রেণির প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা অনিয়ম ও দুর্নীতি করে বার বার পার পেয়ে যাওয়ায় হয়ে ওঠেছেন আরো বেপরোয়া। এতে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
চলতি বছর বাংলা স্কুপ ডিপিডিসির আওতাধীন রাজধানীর কাকরাইল, জুরাইন, মাতুয়াইল, কামরাঙ্গীর চর, লালবাগ, মুগদা, খিলগাঁওসহ বেশ কয়েকটি এলাকার বিদ্যুৎচুরি নিয়ে একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসব ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির যথাযথ কর্তৃপক্ষ পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করলেও দায়ী প্রকৌশলী বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের অন্যত্র পদায়ন করে। অসাধু প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা এই পদায়নকে 'প্রাইজ পোস্টিং' ধরে দ্বিগুণ উৎসাহে ফের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে।
ডিপিডিসির সাবেক নির্বাহী পরিচালক, প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা বলছেন, সর্ষের ভেতরে যদি ভূত থাকে তবে ভূত তাড়াবেন কীভাবে? তাঁরা বলেন, গ্রাহককে অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারে সহযোগিতা করা কর্মকর্তা বা কর্মচারী যেই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী সাময়িক বরখাস্ত করতে হবে। প্রয়োজনে একাধিক তদন্ত কমিটি করে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। পক্ষপাত না করে তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলে দুর্নীতিবাজরা ভয় পাবে এবং দুর্নীতি অনেকাংশে কমে আসবে। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল বাংলা স্কুপকে বলেন, গ্রাহকের অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিতরণী কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা জড়িত থাকেন। সেজন্য কর্তৃপক্ষকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আর ভাসমান দোকানগুলোতে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগগুলো স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় হয়ে থাকে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিতরণী কোম্পানিগুলোর টাস্কফোর্সকে আরো তৎপর হতে হবে। সেই সঙ্গে জনগণ যাতে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার না করে, সেজন্য জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে।
ডিপিডিসির ৩৬টি ডিভিশনের দায়িত্বে রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলাম। মূলত এই পদটিই গ্রাহকসেবার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকে। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকজন অসাধু প্রকৌশলী ও কর্মকর্তার সঙ্গে অর্থিক লেনদেনে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ডিপিডিসির একাধিক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিগত স্বৈরাচার সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া এই কর্মকর্তা যোগদান করেই নানাবিধ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি এখন গড়ে তুলেছেন বড় একটি সিন্ডিকেট। আর এই সিন্ডিকেটের সদস্যরাই গ্রাহককে সেবা দেওয়ার নাম করে বিভিন্ন জটিলতায় ফেলে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। প্রকৌশলীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ৫ আগস্টের পর বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদ বিদ্যুৎখাতের দুর্নীতিবাজদের যে তালিকা করেছিল, তাতে ডিপিডিসির এই কর্মকর্তার নামও ছিল। এখনও তিনি কীভাবে স্বপদে বহাল আছেন?
এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে বাংলা স্কুপের প্রতিবেদক গত তিনদিন মুঠোফোনে কল দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) ও ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা নূর আহমদ রোববার (১৮ মে) মুঠোফোনে বলেন, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নে আমাদের ডিভিশনের প্রকৌশলীরা সব সময়ই অভিযান চালিয়ে থাকে। এ ব্যাপারে আমাদের টাস্কফোর্স সদস্যরাও খুব সক্রিয় রয়েছেন। তবে আমাদের লোকবলের সংকট রয়েছে। পর্যাপ্ত লোকবল পেলে পরিস্থিতির আরো উন্নতি হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারে প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংশ্লিষ্টতার দু'একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা থাকতে পারে। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর বিষয়টি কঠোর নজরদারিতে রেখেছি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা বিন্দুমাত্র বরদাশত করা হবে না।
তিনি আরো বলেন, অন্তবর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা এবং বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই মোতাবেক আমি সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছি। আমি অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের আহ্বান জানাব- এই পথ পরিহার করুন। নিয়ম মেনে সংযোগ নিন। অন্যথায় বিদ্যুৎ বিভাগের আইন অনুযায়ী জেল-জরিমানার মুখে পড়তে হবে।
(বিস্তারিত পরের পর্বে)
বাংলা স্কুপ/প্রতিবেদক/এসকে
বার বার ধান খেয়ে যায় 'ঘুঘু'!
গ্রাহকের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিদ্যুৎচুরি!